শিশুরাই আমাদের সেরা সম্পদ। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর দৃষ্টিতে শৈশব হচ্ছে সৌন্দর্য-আনন্দ-স্বপ্ন-সৌভাগ্য-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ চমৎকার বেহেশতের নিকটবর্তী জগৎ। তাঁর ভাষায় শিশুরাই বেহেশতের পতঙ্গতুল্য (প্রজাপতি)। তাদের ভালোবাসায় আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ।
আল কুরআনের শিক্ষা মোতাবেক, শিশুরাই হচ্ছে সৌভাগ্য ও সুসংবাদ। শিশুসন্তানই হচ্ছে চোখের শান্তি। প্রখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন যে ব্যক্তি শিশুকে স্নেহ করে না, তার বাবা-মা কিংবা শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নেই।
আগামী দিনে শিশুরা হবে রাষ্ট্রনায়ক, সরকারপ্রধান, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, শিক্ষক। এ জন্য সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে, নৈতিকতা মূল্যবোধ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর শিক্ষাকাল দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত। মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে শিখতে শুরু করে। তবে জন্মের পর থেকে ১০ বছর বয়সে পৌঁছা পর্যন্ত সময়ই শিশুর মস্তিস্ক বিকাশের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই বয়সেই শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, সৃজনশীলতা, অনুসন্ধিৎসা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিভা বিকশিত হয়। সুতরাং এই বয়স থেকেই একজন শিশুকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চায় অভ্যস্ত করা জরুরি। এ সম্পর্কে তিব্বতীয় নেতা দালাই লামার উক্তি প্রণিধানযোগ্য শিশুর নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বীজ গ্রথিত হয় পরিবারে। তা বিকশিত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর চর্চা হয় সমাজে। তাই সার্বিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তারা যদি সৎ চরিত্রবান হন এবং মার্জিত আচরণের অধিকারী হন তাহলে সন্তানের নৈতিক দিক স্বাভাবিকভাবেই সুগঠিত হবে।
তাই আমি মনে করি, তাদের সাথে কথাবার্তা ও আচার-আচরণ এমন হতে হবে, যা তাদের মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে। বরং ভালো প্রতিক্রিয়া হয়। এমন কিছু বলতে হবে বা করতে হবে তাদের সামনে, যাতে তার মন-মানসিকতা ভালো ও উন্নত হয়ে ওঠে। আদর-সোহাগ করতে হবে পরিমিত। মাত্রাহীন আদর-সোহাগ ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরালে তাদের পরিচ্ছন্ন মানসিকতা সৃষ্টি হবে। যত দূর সম্ভব নিজের কাজ নিজের হাতে করতে অভ্যস্ত করালে তারা আত্মনির্ভরশীল মনোভাবসম্পন্ন হয়ে উঠবে। বেশি জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসিতায় লালন-পালন করলে বিলাসী মনোভাবের অধিকারী হতে বাধ্য। জিদ ও অন্যায় দাবি পূরণ থেকে বিরত রাখা উচিত।
আপনার সন্তানরা যখন তখন জুস, চিপস, আইসক্রিম প্রভৃতি খাবারের বাহানায় কান্নাকাটি শুরু করলে তা কিনতে হাতে টাকা ধরিয়ে দেবেন না। তাকে ধৈর্য ধরে ভালোভাবে আদর, সোহাগ দিয়ে নিরুৎসাহিত করবেন। এ কথা ভুললে চলবে না, আপনার এসব অন্ধস্নেহ আপনার সন্তানের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তারা অন্যায় করলে আল্লাহর ভয় জাহান্নামের আজাবের ভীতির কথা বলা হলে তাদের মধ্যে খোদাভীরুতা সৃষ্টি হবে। অন্যায় কাজে বাধা দিলে তারা ন্যায়-অন্যায় ভাবতে শিখবে। ভালো কাজের জন্য আল্লাহর খুশি হওয়ার কথা এবং জান্নাতের নেয়ামত লাভের কথা শোনালে তাদের পরকালের চিন্তা গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া মহাপুরুষ মনীষীদের নেককার লোকদের জীবনকাহিনী শোনালে তাদের চেতনা বিকশিত হবে।
গরিব, মিসকিনদের দান-সদকা করতে হবে শিশুদের হাত দ্বারা। এতে তারা দানশীল মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠবে।
শিশুরা ভালো কাজ করলে, ভালো লেখাপড়া, পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তাদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে। এতে তারা আরো উৎসাহিত হবে।
বাড়িতে নিয়মিত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। নামাজ শিক্ষা, দোয়াকালাম ইত্যাদি শিক্ষা, সত্য কথা বলা, ভদ্রতা, আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, সালাম দেয়া, চলাফেরা সৌজন্যবোধ ওঠাবসা, পানাহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে শৈশব থেকে অভ্যাস সৃষ্টি করাতে হবে। সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন বই কিনে বাড়িতেই পাঠাগার তৈরি, তাদের বিভিন্ন বই পড়ে জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করুন।
টিভি দেখার একটি সময় নির্ধারণ করে দিন। মোবাইল ফোন ও টিভির রিমোটটি বেশি হাতে দেবেন না। সন্তানের চলাফেরার ওপর বিশেষ খেলায় রাখুন। আমাদের দেশের কিছু মা সচেতনতার অভাবে সাংসারিক কাজকর্মে তারা এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানরা স্কুলে যাওয়ার আগে তাদের খেয়াল থাকে না তারা ভালো করে খেয়ে গেল কি না?
ক্ষুধার্থ থাকায় পড়ালেখায় তারা ভালো মনোনিবেশ করতে পারে না এবং তা দৈহিক বিকাশেও অন্তরায় হয়। আবার হালাল রুজি-সম্পদের দ্বারা সন্তানের ভরণপোষণ না করানোর ফলে সন্তানরা মানুষ হচ্ছে না।
দেশে বিভিন্ন শিশু অপরাধ ও অপরাধীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা দানের পাশাপাশি পরিবারেও অভিভাবকদের মধ্যে নৈতিকার চর্চা বাড়াতে হবে। নিজে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে সন্তানকে নীতিবান হিসেবে গড়ে তোলা যায় না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দ ভুবন সৃষ্টি করতে হবে। স্কুলে পড়ার ফাঁকে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি সুস্থ-বিনোদনের জন্য আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঐতিহাসিক স্থান, নদ-নদী, গাছপালা, পশুপাখির সাথে পরিচয়ের জন্য শিক্ষামূলক ভ্রমণের আয়োজন করতে হবে। শিশুরা প্রকৃতিকে সরেজমিন দেখা ও চেনা-জানার সুযোগ পেয়ে এক নির্মল আনন্দ উপভোগ করবে।
সর্বোপরি শিশুদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষককেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ নীতিবান, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ শিক্ষকরাই হাজারো শিশুকে নৈতিকতার আলোয় আলোকিত করতে পারেন। বাংলাদেশের শিশুদের বিপুল গোষ্ঠীকে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে জনসম্পদে রূপান্তরের ব্রত নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। এত বড় একটি কাজ সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় শিশুদের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হবে সোনার বাংলা। নতুন বছরে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার, আমাদের প্রত্যাশা এ হোক আমাদের স্বপ্ন।
Previous Story
শিশুর খাবারে অরুচির কারণ ও প্রতিকার
Next Story