মাহে যিলহজ্ব গত হয়ে শুরু হতে যাচ্ছে মুহাররম মাস। হতে যাচ্ছে একটি বছরের বিদায় আর একটি বছরের সূচনা। পশ্চিমাকাশে হেসে উঠবে মুহাররমের হেলাল- নতুন বছরের নতুন চাঁদ। জগদ্বাসীকে ডেকে বলবে- বিগত দিনের হিসাব মেলাও। প্রত্যয় গ্রহণ কর নতুন বছরের। পাথেয় সংগ্রহ কর পরকালের।
দিন যায় রাত আসে। সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আসে। ধীরে ধীরে তা-ও ফুরিয়ে যায়। এভাবে বারটি মাস ঘুরতেই কেটে যায় একটি বছর। শুরু হয়ে যায় আবার নতুন বছরের আয়োজন। এভাবে একদিন নিভে আসে জীবন-বাতি। বুদ্ধিমান তো সে-ই যে জীবনের এ মূল্যবান সময়গুলো যথাযথ কাজে লাগায়।
প্রাত্যহিক জীবনে দিন-রাতের এ পরিক্রমা অনেকের কাছেই অনেকটা স্বাভাবিক। তবে জ্ঞানীদের জন্য এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের বহু উপলক্ষ রয়েছে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَاخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآياتٍ لأولِي الأَلْبَابِ .
নিশ্চয়ই আকাশম-ল ও পৃথিবীর সৃজনে এবং পালাক্রমে রাত-দিনের আগমনে বহু নিদর্শন আছে ওই সকল বুদ্ধিমানদের জন্য…।
–সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০
মুহাররম : আল্লাহ্ তাআলার নির্ধারিত সম্মানিত মাস এবং হিজরী বর্ষের প্রথম মাস
হিজরী বর্ষের সর্বপ্রথম মাস- মুহাররামুল হারাম তথা মুহাররম মাস। হাদীসের ভাষায়- শাহরুল্লাহ আলমুহাররাম। আল্লাহ তাআলা বছরের যে ক’টি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মুহাররম তার অন্যতম। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ. فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …
আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।…
-সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
এ চার মাস কী কী? হাদীস শরীফে তা বলে দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমতো মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২
হাদীসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.
রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩
আরো ইরশাদ হয়েছে-
وَأَفْضَلُ الْأَشْهُرِ شَهْرُ اللهِ الَّذِي تَدْعُونَهُ الْمُحَرّمُ.
(রমযানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৪২১৬
প্রকৃতপক্ষে সকল মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মাঝে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরীফকে বিশেষভাবে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কী? কারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মুহাররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হিজরী সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন-
یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ.
লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) হিসাব এবং হজ্বের সময় নির্ধারণ করার জন্য। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৯
মুসলমানদের বহু দ্বীনী বিষয়, বিশেষ করে হজ্বের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের উপর। আরবী মাস-বছরকে ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবী হিজরী চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মুহাররম। মুহাররমকে ঘিরেও রয়েছে শরীয়তের সুন্দর সুন্দর বিধান ও আমল। ফলে দ্বীনী দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরী মাস-বর্ষের গণনা এবং এর শুরু-শেষের হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য সবিশেষ কাম্য।
দশ মুহাররম ‘ইয়াওমে আশুরা’ : গুরুত্ব ফযীলত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মুহাররম মাসের সবচে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফযীলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলী সমাজে এবং আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-
كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ، وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الكَعْبَةُ، فَلَمّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ، قَالَ رَسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: مَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ، وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ.
(জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হত। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯২
এ হাদীসদ্বয় থেকে বুঝে আসে- জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ দিনে তারা কাবা শরীফে গেলাফ জড়াত। এ দিন তারা রোযা রাখত। নবীজীও এ দিন রোযা রাখতেন। হিজরতের পরও এ দিন রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা এখন মুস্তাহাব।
এরপর যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন দেখেন, মদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোযা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদ্যাপন করছে। নবীজী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন-
مَا هَذَا الْيَوْمُ الّذِي تَصُومُونَهُ؟
এ দিনে তোমরা কী জন্য রোযা রাখছ? তারা বলল-
هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ.
এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হযরত মূসা আ. ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হযরত মূসা আ. এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।
নবীজী এ শুনে বললেন-
فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ.
হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজী নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বললেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩০; সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২৫, ৩৯৪৩
ইহুদীদের নিকট এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদ্যাপন করত। হযরত আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত-
كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ، وَتَتّخِذُهُ عِيدًا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صُومُوهُ أَنْتُمْ.
আশুরার দিন এমন একটি দিন, যে দিনকে ইহুদীরা সম্মান করত এবং এ দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩১
রোযা ও তাওবা : আশুরার বিশেষ আমল
আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে এ দিনের রোযা রাখা। পূর্ববর্তী হাদীসগুলোতে আমরা মাত্রই যা দেখে এলাম। এ দিনের রোযার ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.
আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا اليَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ.
অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোযা রাখতে দেখিনি এবং রমযান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখতে দেখিনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩২
সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন-
যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে।
ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬
(সুবহানাল্লাহ! সাহাবায়ে কেরাম সন্তানদেরকে সেই শিশুকাল থেকেই কীভাবে তরবিয়ত করতে থাকতেন! আর মুমিন মায়েরা নিজেদের সন্তানদেরকে আমলে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার প্রতি কতটা সজাগ-সচেতন ছিলেন!!)
অতএব এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে আমরা খুব ইহতিমাম করব।
এছাড়া এর সাথে যেহেতু মিশে আছে আল্লাহর রহমত ও নাজাত লাভের ইহিহাস, তাই এ দিনে কীভাবে আল্লাহর রহমত পেতে পারি এদিকে খুব খেয়াল রাখব। তেমনিভাবে যেহেতু গুনাহ মাফেরও ঘোষণা এসেছে এ দিনে, তাই তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতিও খুব মনোযোগ দেব। আর একজন মুমিন তো রোযা অবস্থায় আল্লাহর রহমত লাভের অধিক প্রত্যাশী হয়।
Previous Story
শিশুর পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার ৫টি উপায়
Next Story